বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

একটি দূর্ঘটনা ও ভালোবাসা"

শায়লার পাশে চুপচাপ বসে আছে শান্ত। শান্ত মোটেও কোন শান্ত মানুষ নয়! তবে মাঝে মাঝে যখন শান্ত থাকে তখন তার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে শায়লার! তবে এই সুযোগ সে খুবই কম পায়। কেননা, এই শান্ত যতক্ষণ না বাসায় থাকে ততক্ষণ খুবই অশান্ত থাকে! শান্ত ও শায়লা দুজনই এখন গাড়ীতে, গন্তব্য হাসপাতাল!

প্রায় দেড় বছর আগের এক কুয়াশা ঢাকা সন্ধ্যায় শান্ত ও শায়লার বিয়ে হয়! এটা কোন লাভ ম্যারেজ ছিল না, উভয় পক্ষের মুরুব্বীদের ইচ্ছায় ঘটে যাওয়া অ্যারেন্জ ম্যারেজ। বিয়ের আগে তারা দুজন দুজনকে চিনতও না! বিয়ের পরই শায়লা ও শান্ত একে অন্যের পাশে আসল! শায়লা সবসময়ই ভাবত, সে যেন এক স্বপ্নের মাঝে আছে! দেড়টা বছরে সেশান্ত কে অনেক অনেক ভালোবেসেছে, কাছে এসেছে, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করেছে! আর এখন শায়লা তার শরীরে অনুভব করছে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব, দেহে বয়ে বেড়াচ্ছে তার নিজের ও শান্তর মিলিত সত্ত্বাকে!

হাসপাতাল থেকে ফিরছে দুজন, ডাক্তার জানিয়েছে তাদের মেয়ে হবে! খুশীতে আত্মহারা শায়লা বুঝতে পারছে না সে যে কী করবে! শুধু শক্ত করে শান্তর হাতটা চেপে ধরে রাখছে! প্রাণ ভরে দেখছে শান্তর দুষ্টামী মাখা হাসিটা! আহ্, কী সুখ!

হাসপাতালে শুয়ে আছে শায়লা! এই মাত্র সে তার কন্যাটির জন্ম দিল! মেয়েটি কী ফুটফুটে! কিন্তু এ কী! মেয়ের মুখ দেখে সবাই হাসছে না কেন ?শান্তরও দেখি মুখ কালো! কী হল?

কিছুক্ষনের মাঝেই সবকিছু পরিষ্কার হল শায়লার কাছে। তার কলিজার টুকরা, চোখের মণি, তার মেয়েটি তার কথা বলার শক্তিটা কোথায় যেন হারিয়ে রেখে এসেছে! তাতে কী হয়েছে? শায়লা ভাবে, সবারই কথা বলতে হবে এমন কী কোন কথা আছে !?শায়লা এভাবেই হিসাব মিলতে থাকে, কিন্তু হিসাব মিলাতে ব্যর্থ হয় শান্ত।

শায়লার মেয়ে স্মরণের আজ তৃতীয় জন্মদিন! স্মরণ কথা বলতে না পারলেও সবই বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে, সে আলাদা। সবাই কত কথা বলে, কিন্তু সে পারেনা! সবাই তাদের বাবা মায়ের সাথে কত্তো আদরে ভালোবাসায় থাকে। কিন্তু স্মরণ জানে, তার মা ছাড়া আর কেউ তাকে ভালোবাসেনা। ছোট্ট স্মরণ এটাউ বুঝতে পারে যে, সে অন্যরকম বলেই তার বাবা তাকে নিয়ে তার মার সাথে থাকেনা। স্মরণ অনেক বার তার বাবার ছবি দেখেছে। ছবিটা দেখলেই তার মনে হয় ঝাঁপ দিয়ে সে তার বাবার বুকের ওপর পড়ে! কিন্তু সামনা সামনি কখনো দেখলে সে আর এমন চিন্তা করতে পারে না!বরং ভয় পেতে থাকে!

শান্তর হঠাৎ ঐ পরিবর্তন শায়লার আজও অবাক লাগে! এই মানুষটাকে সে এত্তো ভালোবেসেছিল! এই মানুষটা তাকে এত্তো ভালোবেসেছি! যে কি না নিজের সন্তানের জন্মের এক বছর পর শায়লাকে উপহার দেয় একটি ডিভোর্স লেটার! স্মরণের জন্মের পর এটিই ছিল শয়লার জন্য তার প্রথম উপহার! মাথার উপর ভাঙা আকাশ, চোখের উপর ভাঙা স্বপ্ন আর বুকের মাঝে স্মরণকে জড়িয়ে রেখেই সে সাইন করে দিয়েছিল।

স্মরণের জন্মের পর শান্ত আবার বিয়ে করে মুক্তিকে। সে আজ প্রায় সাত বছরের ঘটনা। বিয়ের দুই বছর পর মুক্তি জানল সে কখনো মা হতে পারবে না। শান্তও জানল, তার দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে `বাবা' ডাকটি শুনাতে পারব না। ঐদিনই শান্তর আকাশ ভাঙতে থকে।তার নে পরতে থাকে স্মরণর কথা। কিন্তু সে ফিরে যেতে পারে না।এইবার তাকে বাধা দেয় তার বিবেক।

কাফনে মোড়ানো মুক্তির দেহটির পাশে বসে আছে শান্ত। মুক্তি বুঝতো, শান্ত তার সাথে যে ব্যবহারটা করে তা তো তার নিজেরই দোষে। সেই তো ব্যর্থ হল শান্তকে `বাবা' ডাক শুনাতে। দীর্ঘ সাতটি বছর পর তাই আজ মুক্তি চিরতরে মুক্তি দিল শান্তকে, মুক্তি পেল স নিজেও।

মুক্তির মৃত্যুর ১৪ দিন পরঃ স্কুল থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করেছে স্মরণ। সে হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছে, ভয় নেই, ভালো আছে স্মরণ। তবু শয়লার চিন্তা কমে না।৭টি বছর সে একলাটি পার করেছে স্মরণের সাথে।অতীত মনে করে শায়লা-স্মরণের জন্ম, শান্তর চলে যাওয়া, হঠাৎই তার মন হয়, আজ যদি শান্ত থাকত!দুহাত মাথা চপে ধরে সে । এমন সময় তার পিঠ স্পর্শ করেকটি হাত- শান্ত।শান্ত ক্ষমাপ্রার্থী, তার মেয়ের কাছে, স্ত্রীর কাছে।

স্মরণ সুস্থ হয়ে ফিরল বাসায়! জীবনে প্রথমবারের মত সে দেখতে শুরু করল মা বাবা তাকে একসাথে ভালোবাসছে! সত্যিকার ভালোবাসা...!

পোস্টটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন