রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৩

ভালোবাসার টানে :

Picture
চৈত্রের দুপুর।প্রকাণ্ড শিরিষ গাছের ছায়া এসে পড়েছে টুসীদের বারান্দায়।সেই ছায়ার নিচে বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে একটা গল্প লেখার চেষ্টা চানিয়ে যাচ্ছে সে।দুটো লাইন লিখে;আবার কাটে।বিষয়টাযেন মনঃপুত হয় না তার।এখনো স্থির করতে পারছে না কিভাবে শুরু করবে।শুধু একটার পর একটা কাগজ নষ্ট করে যাচ্ছে।
‘আচ্ছা,ছাগলটাকে ­ নিয়ে লিখলে কেমন হয়?’মনে মনে ভাবছে সে।ওর কথা মনে পড়তেই মুখটা লাজে রাঙ্গা হয়ে ওঠে।
‘ছাগলটা কি আমার মনের কথা বোঝে না?নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে?’এটা ভেবে পরক্ষ্ণণেই আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
‘ওর যা মাথা,কখনোই বুঝবে না!আচ্ছা,আমি ওকে কিভাবে বলব?ছাগল,আমি সারাজীবন তোর কাঁঠালপাতার স্পন্সর হতে চাই?হা হা হা!’ হাসতে থাকে টুসী।
ছাগলটার নাম অয়ন।টুসীর সাথেই পড়ে।এইচ।এস।সি। দিয়েছে দুজনে এবার।সেই পিচ্চিবেলা থেকে বন্ধুত্ব তাদের।একসাথে পড়েছে,খেলেছে,পা ­হাড় চষেছে।ক্লাসের পড়া আর খেলনা শেয়ার করতে করতে কখন যে মনের সব কথা শেয়ার করতে শুরু করেছে জানে না এদের কেউই।
সেই ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে নতুন প্রজাতির গাছ খুঁজে বের করা টুসীর নেশা।তাদের এলাকায় কোন গাছের কি নাম,কি তাদের গুন সব মুখস্থ বলে দিতে পারে সে।বনজংগলে একা একা ঘোরা মায়ের কঠোর নিষেধ।কিন্তু কে শোনে কার কথা!অয়ন যদি কখনো বলে, ‘আন্টি দেখে ফেললে?’ সে অকপটে উত্তর দেয়, ‘দেখলে দেখবে!আমি কি আর একা ঘুরছি নাকি?তোকে দেহরক্ষক রেখেছি কি করতে?’
অত্যন্ত খাঁটি কথা।সে তো আর একা যাচ্ছে না।আর কিছু বলতে পারে না অয়ন।মেয়েটির সব কথা সে মেনে নেয় চোখ বুজে।
এদের বন্ধুত্বটা কিভাবে হল সেটিও ভাববার বিষয়।দুজনসম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের।টুসী চঞ্চলমতি,অস্থির ­মনা।সারাক্ষণ শুধু পটর পটর করবে।আর সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়বে নতুন কোনো গাছের সন্ধানে।অপরদিকে ­ অয়ন শান্তশিষ্ট,চুপচ ­াপ ধরনের।যত কম কথা বলতে পারে,ততই যেন তার শান্তি।হ্যাঁ,না ­ বলে প্রশ্নের জবাব শেষ করতে পারলেই সে পালিয়ে বাঁচে।তার প্রধান কাজ হল টুসীর সাথে সাথে ঘোরা আর তার কথা মনযোগ দিয়ে শোনা।শুনতে হয় কারন টুসীর ধারনা যে তার কোনো কথাই শোনে না।তাই কথা বলতে বলতে হঠাত প্রশ্ন করে বসে, ‘এতক্ষণ কি বলেছি বল।’ঠিকমত জবাব দিতে না পারলে খুব রেগে যায় সে।একবার তো এক সপ্তাহ কথা বলেনি।তখন কি যেকষ্ট হয়েছিল!তাই সে টুসীর প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শোনে।

‘পাগলীটা এমন কেন?’ভাবছে অয়ন।‘সেদিন বলা নেই,কওয়া নেই হঠাত বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙ্গে।সেই সাথে তুমুল বজ্রপাত।এই সময়ে মেয়েটা কিনা ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠের দিকে ছুটে গেল।একটা মানুষ বৃষ্টি এত ভালোবাসতে পারে!নিজের কোনো খেয়াল নেই!যদি কিছু হয়ে যেত!’

টুসী এখন গল্প লেখার কথা বেমালুম ভুলে গেছে।তার অয়নের কথা ভাবতেই বেশি ভালো লাগছে।সেদিন মুভি দেখার সময় কি কাণ্ডটাই না হয়েছিল!সে চাইছিল অয়ন তার হাতটা ধরুক।কিন্তু গাধাটা এমন ফ্যালফ্যাল করে পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিল!তখন টুসী ইচ্ছে করেই তার হাতটা অয়নের হাতের খুব কাছে রাখল।কিন্তু উনার খবর নাই!নিবিষ্টমনে মুভি দেখেই যাচ্ছেন!এত্ত রাগ হল!ইচ্ছে করছিল একটা একটা করে গাধাটার চুল ছিঁড়তে।হঠাত একটা হাতের স্পর্শ তার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বইয়ে দিয়ে গেল।অয়ন তার হাত ধরার চেষ্টা করছে।সে আড়চোখে দেখল বেচারা সংকোচ বোধ করছে।যদি টুসী রাগ করে!একটু ছুঁয়েই হাত সরিয়ে ফেলল অয়ন।
‘ধুর গাধা!আমি কি হাতটা সরিয়ে ফেলতাম নাকি!ছাগল একটা!’মনে মনে বলল টুসী।এরপর অয়নের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে তাকে।
‘স্যরি। এত্তবড় ভুল আমার কি করে হয়ে গেল আমি নিজেই জানি না।হঠাত করে তোর হাতটা আমার হাতে এসে লাগাতে আমার কেন জানি তোর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করল।তুই রাগ করিস নি তো?’ভয় পাওয়া গলায় বলছিল অয়ন।
সেই মুহূরতে একটু রাগ দেখিয়েছিল টুসী।কিন্তু মনে মনে তো সে খুশিই হয়েছিল।

অয়ন বুঝতে পারছে না কিভাবে সে তার মনের কথা বলবে।টুসীকে তার বেশ ভয় লাগে।ও যেরকম মেয়ে,কখনো কারো প্রেমে পড়বে বলে মনে হয় না।পাছে বন্ধুত্বটাই না নষ্ট হয়ে যায়।
আজ সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে তার।

রাতে টুসী তার মা-বাবার সাথে খেতে বসেছে।বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই সে চিমসে গেল।এত রেগে আছে কেন?এম্নিতেই বাবাকে বেশ ভয় পায় সে।এখন তো প্রাণটাইবের হয়ে হাতে চলে আসতে চাইছে।
খাবার টেবিলে কেউ কোনো কথা বলল না।রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় রাদিত সাহেব তার মেয়েকে ডাকলেন।
‘তোমাকে একটা ইম্পরট্যান্ট কথা বলার জন্য ডেকেছি।বস।’
‘জ্বী,আব্বু।’
‘তোমার ওই বন্ধুটার নাম কি যেন?সবসময় তোমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করে?’
‘অয়ন।’
‘ওর সাথে তোমার মেলামেশা আমার পছন্দ না।’
টুসী চুপ করে রইল।
‘রুনুর কথা মনে আছে?’
‘জ্বী।’
টুসীর সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল ওর ফুফাতো বোন রুনু।তার ভালোবাসার মানুষটিকে পরিবার মেনে নেয়নি দেখে গোপনে বিয়ে করে তারা।সেইদিন থেকে এই পরিবারের সাথে তার সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন বাবা।
‘যদি কখনো শুনি কোনো ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে তাহলে তোমাকে আমি ত্যাজ্য করব।এলাকায় তোমার বাবার একটা স্ট্যাটাস আছে।তোমার কারণে যেন সেটিতে কোনো দাগ না লাগে।মানুষ মুখিয়ে আছে এই পরিবারের সুনামে কলঙ্ক লেপে দিতে।তাই সবসময় সাবধানে থাকবে।’
টুসী মাথা নিচু করে সব শুনে গেল।
‘এখন যাও।’
রুমে এসে লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল টুসী।একসাথে অনেকগুলো ভাবনা তার মাথায় চেপে বসেছে।কিছুক্ষণ এরকম থাকার পর একসময় মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।এই সময় তার বোধ শক্তিও কাজ করছিলনা।অতীত বর্তমান ভবিষ্যত যেন এক মুহূর্তে লয় পেয়ে গিয়েছিল।কয়েক সেকেন্ড বাদেই তার বাঁ চোখ উপচে বন্ধ পাতার কোণ দিয়ে একটা অবাধ্য জলের ধারা গড়িয়ে গেল কানের দিকে।সে মোছার চেষ্টা করল না।

আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে।একটা জিনিস এত্ত সুন্দর,এত্ত সুন্দর কিভাবে হয়?ভূতের মত হা করে তাকিয়ে আছে অয়ন।সে ঠিক করেছে প্রতি কৃষ্ণপক্ষের রাতে টুসীর হাত ধরে চাঁদ দেখবে।জোতস্নাস্ ­নান করবে।আর টুসীর কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনবে।
ঘড়ি টিকটিক করে উঠল।আর মাত্র আধা ঘন্টা সময় হাতে আছে।ঠিক ১২টা বাজলেই টুসীকে ফোন করবে সে।বলে দেবে তার ভালোবাসার কথা।ঘুম ভেঙ্গে এসব শুনে মেয়েটা কি চমকানোটাই না চমকাবে।এই প্রথমবার অস্থির হতে দেখা যায় স্থিরমনা ছেলেটিকে।

টুসী জেগেই ছিল।বালিশে মুখ গুঁজে আছে সে।একটু ভালো করে লক্ষ করলেই দেখা যাবে সে কাদঁছে।নিশ্চুপে ­।শুধু জল গড়িয়ে পরছে তার গাল বেয়ে।এমন সময় মোবাইলের ভাইব্রেশনটা বেজে উঠল।স্ক্রিন না দেখেই ফোনটা রিসিভ করল সে।
ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ বেজে উঠল, ‘হ্যালো,টুসী?’
সে কোনো জবাব দেয় না।কন্ঠটা চিনতে অসুবিধে হয়না তার।
‘কি সুন্দর জোতস্না হয়েছে দেখেছিস?দাঁড়া একটা গান শুনাই তোকে। ’ওপাশের মানুষটি তাকে কথা বলার সুযোগ দেয় না।যেন আজ শুধু তারই কথা বলার দিন।
গিটার বাজিয়ে গান শুরু হয়...যখন নিঝুম রাতে...সবকিছু চুপ...নিষ্প্রাণ ­ নগরীতে ঝিঁঝিঁরাও ঘুম...আমি চাঁদের আলো হয়ে...তোমার কালো ঘরে জেগে রই সারা নিশি...এতটা ভালবাসি........ ­.টুসী,তোকে খুব ভালোবাসি রে।’
আবেগ জড়ানো কন্ঠটা চিনতে অসুবিধা হয় না তার।কিন্তু পুরো সময়টাতেই মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না।কেউ যেনআঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে তার মুখটা।শুধু দুচোখ বেয়ে জল গড়ায়।ফোনটা কেটে দেয় টুসী।সে চায়না অয়ন তার কান্না শুনুক।
‘হ্যালো...টুসী. ­..হ্যালো...ফোনট ­া কেটে দিল কেন?’ধাক্কা লাগে অয়নের বুকে।‘কিছু হয় নি তো আবার?নাকি ফোনটা অন্য কেউ ধরেছিল?’ টুসীর বাবার কথা মনে হতেই আতংকে জমে যায় সে।প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর ভয়ে বুকটা চিরে যেতে চায়।এত কষ্ট হচ্ছে কেন?লোনা পানির ধারা নারী-পুরুষ মানে না।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।এরই মধ্যে টুসী তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছে।তার চোখফেটে জল নামছে।নামুক।প্র ­তিটা মেয়েই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চোখের পানি ফেলে।
বি.দ্র.-গল্পের উপসংহারটা আমি পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।ভাবুন না আপনারা আপনাদের ইচ্ছামত!আশাবাদী ­ হলে ধরে নিন সে সমাজের,পরিবারের ­ বন্ধন ছিন্ন করে ভালোবাসার টানে ছুটে গেছে।আর আমার মত নিরাশাবাদী হলে সমাজের কাছে তাকে মাথা নুইয়ে ভালোবাসার কাছে হেরে যেতে দিন।

লাবণীর কান্না ঃ

যেদিন লাবণী কেঁদেছিল

লিখেছেন লাবণী

একটু আগে লাবনী গেলো । রিকশায় করে , লাল জামা পড়ে । প্রতিদিনই অরণ্য দারিয়ে থাকে লাবনীকে এক ঝলক দেখার আশায় । তবে ভাব করে যেন কোথাও যাচ্ছে । এই নিয়ে ৭ম বার হল , মুখ ফুটে "কোথায় যাও" ছাড়া আর কিছু বলতে পারলনা । অনেক কিছু বলার ছিল লাবনীকে , এক ঝলক দেখলে অরণ্য মন কেমন অশান্ত হয়ে উঠে । অশান্তিকে তো খারাপ লাগার কথা । কিন্তু এই অশান্তিকে অরণ্যর ভালই লাগে । কেমন যেন একটা মধুর জ্বালাতন থাকে সারাটাদিন । হয়ত একেই ভালবাসা বলে।
আজ পহেলা বৈশাখ , ১৪ই এপ্রিল । হিসাবমতে আজ বাংলা নববর্ষ । কিন্তু এই দিনকে আজকাল কেন জানি অরণ্যর কাছে ভ্যালেন্টাইন্স ড্যা এর মত মনে হয় । মা - বাবার চোখ ফাকি দিয়ে মেয়েরা লাল শাড়ি পড়ে আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পড়ে রিকশায় করে ঘুরাঘুরি করে । এই দিনে আপনি রিক্সার দিকে তাকান , দেখবেন ৪টা রিক্সার মধ্যে ৩টাতেই একজন তরুন এবং একজন তরুনি হাত ধরে একজন আরেকজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । দুইজনের চোখ দিয়েই অনেক কথা বলা হয়ে যায় । সব প্রেম প্রকাশ হয়ে যায় চোখের পাতায় বেড়িয়ে আসার আপ্রান চেষ্টায় থাকা দু ফুটা চোখের জল । এই প্রমের দৃশ্যগুলা দেখতেও একটা অন্যরকম আনন্দ আছে । কেও মনে হয় সত্যি ই বলেছেন " প্রেম স্বর্গ থেকে আসে " ।
অরন্য তাই এই দুই নম্বর ভালবাসা দিবসকেই ভালবাসা নিবেদনের জন্য পছন্দ করে নিলো । সে হ্যা করুক আর নাই করুক । অরন্যর হাতের লাল গোলাপ ছুড়ে মারুক মুখের উপর , বাম হাত দিয়ে সবার সামনে চড় মারুক তবুও শুধু লাবনীকে জানাতে চায় যে এই পৃথিবীতে একজন আছে যে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লাবনীকে ভালবাসবে । বুকের গভিরোতম অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হবে শুধু তার ভালবাসার জন্য ।

লাবনীকে অরন্য হয়তো কখনও ভালবাসি বলত নাহ । ওর ভয় যদি লাবণী ওকে ভুল বুঝে ? ও যদি বলতে না পারে যে ও লাবনীকে কি রকম ভাবে ভালবাসে তাহলে তো ওর প্রেম বৃথা যাবে । হয়তো লাবণী বুঝবেনা অরন্যের এই হৃদয়ের প্রতিটি হৃদস্পন্দন কেমন করে ভালবাসি ভালবাসি করে হাহাকার করে । কিন্তু সেদিন আমি ওকে বললাম যে এইরকমে লুকিয়ে লুকিয়ে আর কতদিন ভালবাসবি ? এই রকম "কেহ দেখিবে না মোর গভির প্রণয় , কেহ জানিবে না মোর অশ্রুবারিচয় " আর কত করবি ? গিয়ে বলে দে না গাধা । এত ভয় কিসের ?
অরন্যঃ "কিন্তু তানিয়া , ও যদি না করে তাহলে ?"
আমি বললাম (তানিয়া) "না করলে করবে । কিন্তু মনের কথা এর জন্য গোপন রাখবি?"
অরন্যঃ "তর কথাও ঠিক । বলতে হবে আমাকে । আমার প্রেম সত্যি হলে অবশ্যই হ্যা করবে । "
এই হল অরন্যর প্রেম নিবেদনের সাহসের জোগান । জোগানদাতা হলাম আমি , তানিয়া ।
" আমি তোমাকে ভালবাসি" , পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলা কথা । সবচেয়ে কঠিন কথাও মনে হয়। এবং অবশ্যই সবচেয়ে সুন্দর কথা । যতই ভালবাস না কেন , ভালবাসি বলা ততটাই কঠিন । যত বেশি ভালবাস, তত বেশি হারানোর ভয় । আজকের জন্য অরন্যর সব ভয় দূরে থাক । আজকে অরন্যকে বলতেই হবে , হয়তো কাল কখনো আসবেনা ।

লাবনীকে দেখা যাচ্ছে । পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে নৌকায় পা দুটো দুলিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে । কতো সুন্দর হাসি । শুধু এই হাসিটা সারাজিবন দেখার জন্য অরন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারবে । এই হাসির জন্য অরণ্যর জীবন দিতেও কনো আফসোস নেই । অরণ্য পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাল গোলাপটা বের করল । লাবণী এখন নৌকা থেকে নামল । অরন্যকে এখন সেই তিনটা শব্দ বলা লাগবে । লাবণী নৌকা থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে মাঠের সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে । গোলাপ হাতে নিয়ে অরণ্যও আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে লাবনীর দিকে । ধুপপপপ !!! কাহিনিতে নতুন চরিত্রের প্রবেশ ! রোহিত ।
লাবণী অরণ্যর কাছাকাছি আসার আগেই রোহিতের হাত ধরে চলে গেলো । হয়তো একেবারেই চলে গেলো । অরন্যর হাতের লাল গোলাপ নিচে পড়ে গেলো । শরীর ভরশুন্য হয়ে গেলো । গোলাপটা তুলতে চাইল অরণ্য । আর যাই হোক প্রথম প্রেমের প্রথম গোলাপ তো । লাবণীকে ভালবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এতে । হয়তো এই গোলাপ নিয়েই সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে , সারাজীবন ।
তিন দিন পরঃ
তো কি হয়েছে লাবণী অন্য কাওকে ভালবাসে ? অরণ্যও বাসে । সবচেয়ে বেশি বাসে । লাবণী অন্য কাউকে ভালবাসে তারমানে এই না যে অরন্যকে ভুলে যেতে হবে । অরন্যর ভালবাসা অরন্য অবশ্যই প্রকাশ করবে । লাবণী হ্যা করুক আর নাই করুক , শুধু জানাতে চায় যে এই পৃথিবীতে অরন্যর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত অরন্য লাবনীকে ভালবাসবে । প্রেম নিবেদনের জন্য সেই সাহস এখন আর অরন্যর মনে নেই । তাই এক বোতল ভোদকা গলাধঃকরণ করলো ।

অরন্য এখন লাবনির দুইতালা বাসার বারান্দার গ্রিলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে । চোখ লাল হয়ে আছে , মাথার চুল উশকোখুশকো হয়ে আছে । হাত এবং শরীর ক্রমাগতভাবে কাপছে । যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে দুইতালা থেকে নিচে । আগে থেকে কুড়িয়ে আনা ঢিল লাবনীর কাছের আলমারিতে মারলো । সরাসরি লাবনীর গায়ে মারতে পারতো কিন্তু লাবনীকে আঘাত করা অরন্যর পক্ষে সম্ভব না । লাবণী ঘুম থেকে উঠলো । তারপর চিৎকার দিতে গিয়েও মুখ সামলিয়ে আস্তে আস্তে বারান্দায় চলে আসল ।
লাবনিঃ এত রাতে বারান্দায় ঝুলতেছ কেন ? সমস্যা কি ?
অরন্যঃ সমস্যা একটাই । তোমার কথা কখনই ভুলতে পারি না ।তোমার প্রেমে পড়ে গেছি । যেখানেই তাকাই শুধু তুমি আর তুমি । যেখানেই যাই শুধু তোমার হাত খুঁজি ধরার জন্য । পড়তে বসলে তোমার কথা মনে পরে । আর যখন সবকিছু বাদ দিয়ে ঘুমাতে যাই তখন তুমি স্বপ্নে এসেও হানা দাও । এসে সেই ভুবন ভুলানো হাসি দাও আমার দিকে তাকিয়ে , আমি তো তখনই প্রেমে পড়ে যাই ।
লাবণীঃ অরন্য তুমি জানো রোহিতের সাথে আমার রিলেশন আছে । তাহলে এই পাগলামির মানে কি ?
অরন্যঃ কারন আমি তোমাকে ভালবাসি । ওই রোহিত থেকে অনেক বেশি ভালবাসি । সবার থেকে বেশি । তোমাকে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাই । তুমিই প্রথম প্রেম , তুমিই শেষ ।
লাবনিঃ প্রথম প্রেম বলতে কিছু নেই । প্রেম বারবার হতে পারে ।
অরন্যঃ তাও ঠিক । আমার জীবনে প্রেম একটাই । কিন্তু ফিরে আসে বারবার । যতবার তোমাকে ভুলে যেতে চাই , ততবার আরো বেশি করে প্রেমে পড়ি ।লাবনিঃ অরণ্য , তুমি আমার ভাল বন্ধু । তোমার ভালর জন্যই বলছি । আমাকে ভালবেসে কোন লাভ হবে নাহ । শুধু কষ্টই পাবে । তাই ভাল হয় যদি ভুলে যেতে পারো ।
অরন্যঃ দি লাভ ক্ষতি হিসাব করে প্রেমে পড়তাম তাহলে তো আর তোমাকে ভালবাসতাম না । তোমার ওই চোখ দুটা , ওই হাসিটা আমাকে প্রেমে ফেলে দিয়েছে । এই প্রেম থেকে আমি কি পাব তা কখনো চিন্তা করি নি । চিন্তা করতে চাইও না । আমি শুধু জানি যে লাবণী নামের একটা মেয়েকে আমার জীবনের সব প্রেম , ভালবাসা দিয়ে দিয়েছি । পারলে আমার এই জীবনটাও দিয়ে দিতাম । একবার এই প্রান চেয়ে দেখো , জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে তোমার হাতে এই প্রান তুলে দিব ।
লাবনিঃ বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দাও । সকালে উঠে দেখবে সব পাগলামি চলে গেছে । এই এইজে প্রেম হয় না , এটা শুধু কিছুদিনের ইমোসন । কয়েকদিন পরে চলে যাবে ।
অরন্যঃ ( লাফ দিয়ে নিচে নেমে , চিৎকার করতে করতে ) লাবণী , শুধু জানাতে এসেছিলাম আমার মনের কথা । শুধু জানাতে এসেছিলাম যে এই পৃথিবীতে কেউ একজন তার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে ভালবাসবে । তুমি চাও না চাও আমি তোমাকে ভালবাসব । এর কারন এই না যে অন্য কোন মেয়ে পাই না । এর কারন এই যে তুমি আমার প্রথম প্রেম , এবং শেষ । মরার আগ মুহূর্তেও বলব "লাবণী আমি তোমাকে ভালবাসি" , আই প্রমিস ।
লাবনিঃ টাটা।
অরন্যঃ নেভার স্যা নেভার লাবণী । এই জীবন অনেক বড় । একবার না একবার তো দেখা হয়েই যাবে ।
তিন বছর পরঃ
আমরা পিকনিকে যাচ্ছি । কক্সবাজার থেকে এখন সেন্ট মার্টিন যাচ্ছি । ৩০ জন ছাত্রছাত্রী এবং ২০ জন শিক্ষক । সাথে আমি, অরণ্য , রোহিত এবং লাবণী । হ্যা , লাবনীকে অরণ্য এখনো ভালবাসে । এখনো লাবনীর রোহিতের সাথে সম্পর্ক আছে । কিন্তু এখন আরো অনেক বেশি ভালবাসে । এখনও এক মুহূর্তের জন্য লাবণী অরণ্যর মন থেকে যায় না । ও অরন্যকে ভালবাসুক না বাসুক অরণ্যর ভালবাসা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে ।
রোহিত আর লাবনীকে দেখা যাচ্ছে । লঞ্চের ছাদের উপর । ওরা টাইটানিকের পোজ দিতে চাইছে । অরন্য আমাকে বলল " গাধায় এটাও জানে না যে টাইটানিকের পোজে ছেলেকে পিছনে দাড়াতে হয় " । আরে ওরা কোথায় যাচ্ছে ? একেবারে লঞ্চের উপরের ছাদে চলে গেলো ওরা । কেউ নেই ওইখানে । জায়গাটা একটু বিপদজনক ।
লাবনীর হাত ধরে রোহিত একবার ওকে ঘুরাল । ওরা নাচছে । আস্তে আস্তে নাচার গতি বাড়তে থাকল । রোহিত লাবনীর হাত ধরে ঘুরিয়ে বামদিকে নিলো তারপর অন্যহাত দিয়ে আবার সামনে আনলো । তারপর একহাত দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়ে আবার কাছে আনলো । কাছে এনে লাবনীকে কোলে নিতে চাইলো । রোহিত ভারসাম্য রাখতে পারলনা । রোহিত ধাক্কা খেয়ে পিছনে সরে গেলো । তারপর রোহিত ঘুরে গেলো । ওর সামন চলে গেলো রেলিঙের দিকে । লাবণী এখনও রোহিতের কোলে । রেলিঙে রোহিতের হাত ঝারি খেলো । রোহিত হাতে ব্যাথা পেয়ে লাবনীকে হাত থেকে ছেড়ে দিলো । নাহ !!! লাবণী সোজা তিনতলা থেকে একেবারে নিচে পানিতে পড়ে গেলো । "রোহিত" , রোহিত" , বলে চিৎকার করতে থাকল । রোহিত নিচে নেমে গেলো । ৩০ জন ছাত্র ছাত্রি এবং ২০ জন শিক্ষকের সবাই রেলিঙের পাশে চলে এল । লাবণী শ্বাস নিতে পারছেনা । একবার ডুবছে আবার ভাসছে । এখনও লাবণী "রোহিত , রোহিত" বলে চিৎকার করছে । আর রোহিত চিৎকার করছে "কেউ লাবনীকে বাচাও , কেউ একজন বাচাও" । তারপর আরেকটা ঝাপের শব্দ শুনলাম । দুইতলা থেকে কেউ একজন ঝাপ দিয়েছে । হয়তো রোহিতের চিৎকার শুনেই লাফ দিয়েছে । নাহ , যে লাফ দিয়েছে সে রোহিতের চিৎকার শুনে লাফ দেয় নি । সে লাফ দিয়েছে তার ভালবাসার জন্য । অরন্য দুইতলা থেকে লাফ দিয়েছে পানিতে । আর আমার মাথায় শুধু একটা কথাই এল "অরণ্য সাতারের কিছুই জানে না" ।
৭ দিন পর: অরণ্য এখনো কোমায় আছে । ডাক্তার বলেছেন ওর ফুসফুসে নাকি পানি ঢুকেছে । পানি না বের করলে ওর শ্বাস নিতে সমস্যা হবে । আবার কোমায় থাকলে অপারেশনও করা যাবে না । যখন কোমা থেকে ফিরে আসবে ঠিক তখনই অপারেশন করা লাগবে ।
লাবণী এই সাত দিন ধরে হাসপাতালে বসে ছিল । আমি যখন খাবার নিয়ে ওর কাছে আসলাম , ও আমাকে বলল , " আমি একটু অরণ্যকে দেখতে পারব ? " । আমি কিছুক্ষন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । ওর চোখে যা দেখলাম তা কখনও আগে ওর চোখে দেখিনি । রোহিতের সাথে থাকার সময় তো কখনোই দেখি নি , দেখেছিলাম শুধুই বিভ্রান্তি । আজকে দেখলাম অন্য কিছু , পবিত্র ।
লাবণী অরণ্যের বেডের পাশে বসে আছে । অরণ্য জীবন মৃত্যুর মধ্যে । আর লাবণী নেই ওর নিজের মধ্যে । লাবণী কথা বলা শুরু করল ।
অরণ্য , জানি না তুমি কোন সময় জেগে উঠবে । যত দেরিই কর না কেন , আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব । তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে , অনেক কিছু অরন্য । ৩ বছর আগে তুমি বারান্দায় ঝুলে যে কথা গুলো বলেছিলে আর আমি হেসেছিলাম সেই কথা গুলো আজকে তোমাকে বলতে চাই । এই রকম অনুভূতি আমার কখনও হয় নি । কি রকম একটা ব্যাথা মনের ভিতর । কিছু একটা হারানোর ভয় সারাক্ষন । আমি এই ব্যাথা নিয়ে ২ দিনও থাকতে পারবনা । তুমি ৩ বছর ধরে কিভাবে থাকলে ? এই অরন্য , শুনছো ? শুধুমাত্র ভালবাসলেই এই ব্যাথা সহ্য করা যায় । আমি কি করতে পারব ?
অরন্য জেগে উঠল । আস্তে আস্তে বলল , " লাবণী ভাল আছো ? "
লাবণী কেঁদে ফেলল । অশ্রু লোকানোর কোনো চেষ্টা করলনা ।
অরন্যঃ আমি তো শুধু কেমন আছ জিজ্ঞেস করলাম । এতে কাঁদার কি হল ?
লাবনীঃ ( নিশ্চুপ ) ।
অরন্যঃ "লাবনী , আমি বলেছিলাম না আমি তোমাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভালবাসবো ? আমি আমার কথা রেখেছি লাবণী । আমি এখনও তোমাকে ভালবাসি । লাবণী শেষবারের মত বলি , আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি । যাই লাবণী , ভাল থেকো " , বলে অরণ্য লাবণীর গালে আস্তে করে একটু হাত দিয়ে ছুঁতে চাইল । লাবণী গাল বাড়িয়ে দিলো । কিন্তু অরণ্যর হাত লাবণীর গাল স্পর্শ করার আগেই থেমে গেলো । অরণ্যকে মরে গিয়ে প্রমাণ করতে হল যে সে ঠিকই লাবণীকে ভালবাসে ।
তিন দিন পরঃ আমি লাবনীর বাসায় গেলাম । লাবণী ওর রুমে দরজা লাগিয়ে বসে আছে । আমি ঢুকলাম রুমে । " লাবণী , অরন্য মারা যাবার পর ওর বেডে এই ডায়রিটা ছিল । এর শেষ পৃষ্ঠায় লেখা ছিল যে ডায়রিটা যেন তোমাকে দেয়া হয় । তাই দিতে আসলাম " , বলে আমি হাত বাড়ালাম ।
লাবণী আমার হাত থেকে ডায়রিটা নিলো । প্রথম পাতা উল্টানোর পরেই সেই লাল গোলাপটা দেখতে পেলো যা হাতে নিয়ে অরন্য লাবনীকে প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিল । গোলাপ মজে গেছে কিন্তু গোলাপের মধ্যে গন্ধ রয়ে গেছে । তিন বছর আগের গোলাপ এখনো গন্ধ রয়ে গেছে ! লাবণী গোলাপটাকে নাকের কাছে নিয়ে তীব্রভাবে গন্ধ নিতে চাইল । তারপর চোখ বন্ধ করে ফেললো । চোখ যখন খুলল তখন দুই ফোটা অশ্রু লাবণীর গাল বেয়ে ঝরে পড়ল । লাবণী পড়তে শুরু করল । প্রথম লাইন এইভাবে শুরু হল " একটু আগে লাবনী গেলো । রিকশায় করে , লাল জামা পড়ে ......... " । লাবনীর চোখ বেয়ে আবারও পানি ঝরল । এবার আরো বেশি পরিমাণে । লাবনী ডায়রিটাকে বুকের কাছে নিয়ে শক্ত করে ধরে কেঁদে উঠল । লাবণী কান্না থামাতে চাইল না । আজ যত অশ্রু ঝরার ঝরবে । আজ লাবনীর কাঁদার দিন । লাবণী আজ কাঁদবে ।

অসমাপ্ত ভালবাসাঃ

যেদিন তোমায় প্রথম প্রপোজ করেছিলাম সেদিন তোমার হাত থেকে বই গুলা পরে গেছিলো। ষ্মার্টনেস দেখাতে তরিঘরি করে বই গুলা তুলে দিতে গেছিলাম। কিন্তু নিজেই পিছলে তোমার ছড়ানো বইগুলার সাথে পরে রয়েছিলাম রাস্তায়। ঠিক সে মুহুর্তেই বৈদ্যুতিক তারে বসে থাকা পাখিটা ইয়ের বোমাটা করে দিছিলো আমার একদম মুখে। মনের ভুলে রুমালটাও আনতে ভুলে গেছিলাম। তখন তুমি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে তোমার রুমালটা আমাকে দিছিলা। রুমালটা নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় তখনো আমার কানে আসছিলো তোমার সেই হাসির আওয়াজ.…

এপ্রিলের নয় তারিখ। সেদিন একটা গোলাপ দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তোমায় আবার প্রপোজ করি। আমি ভাবতেও পারিনি তুমি আমাকে একসেপ্ট করবা।সেদিন আমার হাত থেকে মোবাইলটা পরে গেছিলো। মোবাইলটা নিতে গিয়ে উল্টে পরে গিয়েছিলাম। সেদিন তুমি আমার নাম দিছিলা 'উষ্টা বাবু'। তোমার সেই 'উষ্টা বাবু' ডাকটা শুনতে অনেক মিষ্টি লাগতো।
সেইদিন বৃষ্টির ভেতর তোমার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে আছে তোমার?? আমি একটু সাইডে হিসু করতে গেছিলাম আর তোমাকে বৃষ্টির ভেতর একা দেখে একটা ছেলে ভাব নিতে ওর নিজের ছাতাটা তোমাকে দেয়। আমি তখন রেগে গিয়ে তোমার কাছে জোরে হেটে যেতে গিয়ে কাদায় পিছলে পরে যাই। তুমি ছেলেটিকে ছাতাটা ফেরত দিয়ে দৌড়ে ছুটে এসেছিলে আমার কাছে। বলেছিলে, 'আমার উষ্টা বাবু, উঠো বৃষ্টির ভেতর রাস্তায় ঘুমাতে নেই'
মনে আছে সেইদিন ঘুরতে গিয়ে তোমার বাবা কে দুর থেকে আসতে দেখি। দুজন দুই দিকে দৌড় লাগাই। তুমি তো ঠিকই দৌড় দিয়ে লুকিয়েছিলা কিন্তু আমি দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় উষ্টা খেয়ে পরি। আমার ঠোঁট কেটে রক্ত পরে। তুমি তখন বাবার ভয় আগ্রাহ্য করেই ছুটে এসেছিলা আমার কাছে। আমি তখন আমার রুমাল খুজছিলাম। কিন্তু সেইদিন ও ভুলে রুমাল এনেছিলাম না। তুমি তখন তোমার একহাতে রুমাল দিয়ে আমার ঠোঁট মুছে দিচ্ছিলা আর আরেক হাত দিয়ে আমার কাধে কিল মারছিলা। তোমার চোখে সেদিন প্রথম জল দেখেছিলাম। তোমার বাবা আমাদের পাশ দিয়েই চলে গেছিলেন। মুখে তার ছিলো মুচকি হাসি।
এপ্রিলের নয় তারিখেই আমাদের বিয়ে হয়। সেইদিন বাসর ঘরে সব মালা ছিড়ে ফেলেছিলা তুমি। সব ফুল বিছানার এক যায়গায় জড় করেছিলা। তারপর ফুলের স্তুপ অর্ধেক করে নিজের অর্ধেক থেকে আমার মাথায় ফুল ছিটিয়ে দিয়েছিলা আমিও তখন বাকি অর্ধেক ফুল তোমার মাথায় ছিটিয়ে দিয়েছিলাম।
মনে আছে বাসর ঘরে গ্লাসে করে শরবত খাওয়াতে গিয়ে পুরা গ্লাস আমার মাথায় ঢেলে দিছিলা!! মুছতে গিয়া দেখি রুমাল নেই। তুমি খুব হেসেছিলা। বলেছিলা তুমি নাকি আগেই জানতে যে আমার কাছে রুমাল থাকবে না। তখন তোমার রুমালটা দিয়ে আমাকে মুছে দিছিলা। সেদিন তোমাকে, তোমার হাসি অনেক সুন্দর লাগছিলো।
প্রতিদিন সকালে এককাপ চা বানাতে আমার জন্য। আমার অর্ধেক খাওয়া হলে তুমি কাপটা কেড়ে নিতা। নিয়ে বাকি অর্ধেক তুমি খেতা। বাজারে অনেক খুজে খুজে একটা বড় থালা কিনেছিলা তুমি। তুমি আমি সামনে বসে একসাথে সেই থালায় খেতাম। তুমি আমাকে খাইয়ে দিতা আমিও তোমাকে খাইয়ে দিতাম। আমাদের গ্লাস ও একটাই ছিলো।
বিয়ের প্রথম বর্ষ পুর্তিতে স্পেশাল কিছু চেয়েছিলা তুমি। আমি তো দিতেই চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি ই তো নিলানা। আর কখনো নিবেও না। কি এক অভিমান করে চলে গেছো আমাকে একা করে।
জানো এখনো সেই বড় থালায় খাবার খাই আমি। অর্ধেক খেয়ে বাকি অর্ধেক নষ্ট করি। সকালের সেই অর্ধেক কাপ চা এখনো পরে থাকে। কিন্তু বাকিটুকু আর তুমি কেড়ে খাও না।
জানো আজ এপ্রিলের নয় তারিখ। এই গোরস্থানে আসার পথেও পরে গেছিলাম আমি। কিন্তু 'উষ্টা বাবু' বলে কেউ আর আমাকে ডেকে তুলেনি। দেখো তোমার জন্য গোলাপ এনেছি। পরে গিয়ে একটু মাটি লেগেছে ফুলটায়। তোমার কি পছন্দ হয় নি? দেখো আমি কাঁদছি। চোখ মুছবো রুমালটাও আনতে ভুলে গেছি। কই আমার চোখের জল তো তুমি তোমার রুমাল দিয়ে মুছে দিচ্ছনা। এতোটাই পর করে দিলে আমায়? এভাবে আমাকে ভুলে একা একা কি করে আছো তুমি??
আমাদের বিয়ের প্রথম বর্ষ পুর্তি হবার কথা ছিলো আজকে। তুমি স্পেশাল কিছু চেয়েছিলা আমার কাছে। হ্যা আমি তোমাকে আজ সেটা দিবো। আমি ই তোমার সেই স্পেশাল কিছু। আজ নিজেকে গিফ্ট করবো তোমাকে। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার জন্য আর সম্ভব না। আমি আসছি তোমার গিফ্ট হয়ে।
সকাল বেলা নিমতলা গোরস্থানের একটি কবরের কাছে মানুষের ভিড়। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো একজন মৃত যুবক একটি কবর জড়িয়ে ধরে নিথর পরে আছে। যুবকের এক হাতে ছিলো একটি লাল গোলাপ, অপর হাতে ছিলো একটি বিষের বোতল।.