বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১২

“ছেঁড়া গল্প” 1...



নভেম্বরের এই সময়ে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার কথা না, তীব্র বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বাসের জানালার কাঁচে এসে পড়ছে, ধীরে ধীরে ঝাপসা হচ্ছে বাইরের সব কিছু, বৃষ্টির পানির কাঁচ বেয়ে এলোমেলো খেলা, চাইলেই ছবিটা তুলে রাখতে পারে জাহেদ,
 এই কাজটা সে প্রায়ই করে, একই ছবি, কিন্তু সে তোলে একেকভাবে, এই কাজটা সে করে মুমুকে চমকে দেয়ার জন্য, কিন্তু প্রতিবারই মুমু নির্লিপ্ত থাকে। সে কোন কিছুতেই চমকায় না, জাহেদেরধারণা এই মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে,তীব্র কষ্টের মধ্যেও যে মেয়ে হাসিমুখে থাকে তার মাথায় সমস্যা ছাড়া আর কি থাকবে?
একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মুমুর পা এমন মচকালো, গোড়ালি ফুলে ঢোল। খবর পেয়েই জাহেদ বাসে উঠে পড়ে,ঘরেঢুকেই বিশাল এক ধাক্কা খেলো, মুমুফোলা পা নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে কি জানি খাচ্ছে, পা ফুলে হুলুস্থুল অবস্থা, এই অবস্থায় হাসছে কিভাবে এই মেয়ে?
ওই পাগলা,কতবেল ভর্তা খাবা? মুমুরমুখে বিশাল একটা হাসি।
তুমি কি মানুষ? জাহেদ হতভম্ব।
কষ্ট হচ্ছে এতদিন পেত্নির সাথে ছিলে ভেবে? মুমুর মুখে চাপা হাসি।
জাহেদ তাকিয়ে থাকে।
কি হলো? খাবা ভর্তা?
ব্যাথা কি খুব বেশি?
খুবি বেশি স্যার, কিন্তু আপনাকে দেখে ব্যাথা আরও বেড়ে যাচ্ছে ।
চলে যাব?
অবশ্যই চালে যাবেন।
জাহেদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমার সামনে এইভাবে পর্বত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন না, চলে গেলে যান, আর না গেলে আমার পাশে এসে বসেন, শর্ত একটাই যতক্ষন থাকবেন মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মত করে রাখবেন না আর আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বসে থাকবেন।
এই হলো মুমু।
জানালা লাগিয়ে দিল জাহেদ, বৃষ্টির ফোঁটা বেশ জোরেই বাসের ভিতরে আসছে, ভিজতে ইচ্ছা করলেও সেটা সম্ভব না পাশে বসা মুরুব্বীর জন্য। তিনি কিছুক্ষন পর পরই রুমালে নাক ঝাড়ছেন শব্দ করে, ঝাড়ার পরে বিচিত্র একটা শব্দকরছেন, যদিও সে বুঝতে পারছে না সেটা ইচ্ছাকৃত কিনা।
সকাল সাতটায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও এক ঘণ্টা দেরী করে ছেড়েছে,যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে সে হিসাব করলে মনে হয় না দুপুরের আগে রাজশাহী পৌঁছান যাবে, পূজার পুরো ছুটিটা এবার সে মুমুর সাথেই কাটাবে বলে ঠিক করেছে,প্রতিমাসে একবারের জন্য হলেও সে রাজশাহী আসে মুমুর সাথে টি বাঁধে তাদের নির্দিষ্ট বেঞ্চে বসে ফুচকা খেতেখেতে সূর্যাস্ত দেখার জন্য। জাহেদ অবশ্য খায়না, মুমু খায় সে দেখে। আশে পাশের সব কাকগুলো তখন এলোমেলোভাবে তাদের ঘিরে বসে থাকে। মুমু জাহেদের প্লেট থেকে ফুচকা নিয়ে কাকদের খাওয়ায়। শেষ হলে আবার আরেক প্লেট নেয়া হয় শুধুকাকদের খাওায়ানোর জন্য। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কিন্তু করে না। ও জানে মুমু এমনই। ও এও জানে কাক পোষ মানার পাখি না, কিন্তু টি বাঁধের সেই কাকগুলো মুমুর পোষ মেনেছিল।
পাশের মুরুব্বী নড়াচড়া করছেন অনেক্ষন ধরে,উশখুশ করছেন। একবার গলা খাকারি দিলেন, মনে হচ্ছে বসে আরাম পাচ্ছেন না। বার বার সিটের পাশের লিভার টেনে নিচে নামাচ্ছেন, আবার উঠাচ্ছেন। জাহেদনিজে চেপে বসেছে যাতে মুরুব্বির বসে সমস্যা না হয়, তারপরেও মনে হচ্ছে তার বসাতে আরাম হচ্ছে না। কিছু মানুষ জগতে থাকে এরা কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। এরা নিজেরা অস্থির, আশেপাশের সবাইকেও অস্থির করে রাখে। যেমন এখন জাহেদ সামান্য অস্থির বোধ করছে, কারণ মুমুর ফোন বন্ধ।
জাহেদ নিশ্চিত যে কপাল খারাপ আজকে তার, মুমু হয়তো রাগে দেখাই করবে না। এই মেয়ের রাগও তার মতই মাথা নষ্ট, কখন রাগ হয় আর ঠাণ্ডা হয় আজ পর্যন্তও সে বুঝে উঠতে পারেনি। মুমুর মোবাইল ফোন এখনও বন্ধ বলছে, সকাল থেকে কয়েক বার কল দিয়েছে, অপারেটর এর যান্ত্রিক স্বরে প্রতিবারই একই কথা ভেসে আসে। দরকারের সময় তার ফোন বন্ধই থাকে, এ নিয়ে তার সাথে ঝগড়াও করেছে কয়েকশবার, ঝগড়াতে সাধারণত দুপক্ষ থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এক পক্ষ,যা বলার মুমুই বলে, জাহেদ মাথা নিচু করে থাকে, সে কোনবারেই কিছু বলতে পারে না। একবার শুধু জিজ্ঞেস করেছিল মুমু রাগ কি ওর বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে কিনা, আর যায় কোথায়,সাত দিন কথা বন্ধ। এই মেয়ের সব কিছুই এলোমেলো।
কতবার কত প্রদর্শনীতে জাহেদের ছবি গিয়েছে, জাহেদের মনে ক্ষীণ আশা থাকতো প্রতিবারই মুমু তাকে চমকে দিয়ে হলেও থাকবে শেষ পর্যন্ত, কিন্তু সে আসতো না। যতবারই তাকে এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে জাহেদ সে নির্লিপ্তভাবে বলেছে, ধুর ধুর আমি ছবির কি বুঝি।
যেই মানুষটার জন্য আমি ছবি তুলি সেই মানুষটা থাকবে না?
মুমু হাই তুলতে তুলতে বলে, তোমার সব ছবিতো আমার, আমার জিনিস আমি যখন ইচ্ছা তখন দেখব, অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখতে হবে নাকি?
মুমু কোনোদিন কোন প্রদর্শনীতে আসেনি ছবি দেখতে, একবার শুধু একটাচিঠি লিখেছিল, চিঠি বলা ভুল হবে, চিরকুট বলাই ভাল। সম্পূর্ণ পৃষ্ঠাতে কেবল একটা লাইন, “পাগলা, তুমি কি জানো তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফার?”
জাহেদের দশ বছরের ফটোগ্রাফি জীবনে সব থেকে বড় অর্জন ছিল সেটা।
সবে বাস টাঙ্গাইল পার করলো, ঘড়ি দেখল জাহেদ, এগারটা মাত্র। সমস্ত পথে একই ভাবে বৃষ্টি পড়ছে, জানালাদিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। পাশের মুরুব্বি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো সাড়া শব্দ আসছে না, মুখের ওপরে রুমাল দিয়ে ঢাকা, ভারি নিঃশ্বাসের সাথে রুমাল হাল্কাভাবে কাঁপছে, বোঝা গেল ঘুমিয়ে পড়েছে। এই মানুষগুলো কত শান্তিতেই না আছে; মাঠে, ঘাটে , গাড়িতে কত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ঘুম ভাঙ্গার পরে এমন ভাব করেযেন রাতের ঘুম পার করে এসেছে। জীবন মনে হয় এদেরই।
ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব, শেষবার ভিজেছিল মুমুর সাথে সাহেব বাজার থেকে টি বাঁধে যাওয়ার সময়। প্রফেসর পাড়া পার হতেই চলন্ত অটো থেকে ঝাঁপিয়ে রাস্তায় নেমে দুহাতমেলে ধরে জাহেদ, মুমু নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টির ফোঁটা ছাপিয়ে চিৎকার করে জাহেদ,তোমার মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠবে, তুমি ভিজো না।
আমি ভিজবো, চাপা গলায় বলে মুমু।
অসহায় বোধ করে জাহেদ, কেন এমন করছো?
ব্যাথা আমার হবে, কষ্ট তোমার হবে, অটো থেকে ওইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার শাস্তি।
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে, পানিতে মুখের সাথে চুল লেপটে গিয়েছে মুমুর, পরিস্কার বুঝতে পারে জাহেদ যে মুমু কাঁদছে, বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি আলাদাকরা যায় না, তাও সে বুঝতে পারছে। আরেকটা জিনিস সে সেদিন বুঝলো, একটা মেয়ের সব থেকে বড় অলঙ্কার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন